3
অনেকে চেষ্টা করেও করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করাতে পারছেন না। যারা পরীক্ষা করিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ ফল জানতেও পারছেন না। কয়েকটি ল্যাবরেটরিতে সংগ্রহ করা নমুনার স্তূপ বড় হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা, ভুক্তভোগী মানুষ এবং ল্যাবরেটরি-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এই অবস্থার কথা জানা গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় করোনার পরীক্ষা নিয়ে এমন পরিস্থিতি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সমস্যার বিশালতা অনুধাবন করতে পারেনি। স্বাস্থ্য অধিদফতর কিছুটা দেরিতে পরীক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি এবং নমুনার মানের ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়গুলো দ্রুত পর্যালোচনা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা পরিস্থিতিকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণার আগে থেকেই রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যাপারে জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটি বলছে, চিকিৎসা ও সংক্রমণ প্রতিরোধে রোগ শনাক্ত হওয়া দরকার।
রাজধানীর মোমিনবাগের একটি পরিবারের তিন সদস্যের কয়েক দিন ধরে জ্বর, গলাব্যথা। পরিবারের সদস্যরা একাধিকবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) দেওয়া ফোনে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
গত সপ্তাহে মিরপুর ১১–এর একটি পরিবারের একজন নারী সদস্য করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান। ওই পরিবারের একাধিক সদস্য এখনো জ্বরে ভুগছেন। আইইডিসিআরের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেও কোনো পরীক্ষা করাতে পারেননি। পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে না পারার এ রকম উদাহরণ আরও আছে। অন্যদিকে নমুনা দিয়েছেন, কিন্তু ফল জানতে পারছেন না, এমন উদাহরণ আছে অনেক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা পরিচালনা, ফল জানানো এবং শনাক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতে হবে। এই দুই ধরনের অভিযোগ অনেক মানুষের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, কাজের চাপের কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহের বা সনদ তৈরির সময় ব্যক্তির তথ্যে ভুল হয়ে যায় (যেমন নামের অক্ষরে বা টেলিফোন নম্বরে)। তখন যোগাযোগে সমস্যা হয়।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, কোভিড-১৯ রোগী নন এমন ব্যক্তির জন্য পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফল জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ এ বিষয়ে সনদ না থাকলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না। অন্যদিকে দ্রুত পরীক্ষার ফল জানা গেলে সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজ এগিয়ে যায়।
পরীক্ষার ফল নিয়ে সন্দেহ : রাজধানীর উত্তরায় নিজের মাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারছিলেন না চিকিৎসক ছেলে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ফল দেখতে চেয়েছিল। রাজধানীর একটি ছোট ক্লিনিকে রেখে তার মায়ের নমুনা পরীক্ষা হয়। ১২ এপ্রিল আইইডিসিআরে দেওয়া সনদে দেখা যায়, মা করোনায় আক্রান্ত নন।
চিকিৎসক ছেলে বলেন, সনদ পাওয়ার পরপরই মাকে আমরা রাজধানীর একটি বড় হাসপাতালে ভর্তি করাই। মাকে তারা লাইফ সাপোর্টে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত আইইডিসিআরকে দিয়ে পরীক্ষা করায়, যা পরিবারের সদস্যরা জানতেন না। ১৩ এপ্রিল আইইডিসিআরের দেওয়া সনদে দেখা যায়, তিনি করোনায় আক্রান্ত। ওই চিকিৎসক প্রশ্ন করেছেন, ‘এক দিনের ব্যবধানে কি এটা সম্ভব?’
ওই হাসপাতাল চিকিৎসকের মাকে আর রাখেনি। বাধ্য হয়ে তাকে উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে স্থানান্তর করেন ছেলেরা। তিনি ভালো হয়ে উঠছিলেন। সরকারি ওই হাসপাতাল নমুনা পরীক্ষা করায়। ২২ এপ্রিল আইইডিসিআরের সনদ বলছে, তার শরীরে করোনা ছিল না।
এদিকে, নমুনার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল একটি ল্যাবরেটরি থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয়েছে, মানসম্পন্ন নমুনা আসছে না। অর্থাৎ নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পাত্রজাত করা এবং নমুনা পাঠানোর ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা শনাক্তের পরীক্ষার জন্য নাক ও গলার লালার নমুনা সংগ্রহ করতে হয় বিশেষ কাঠির (সোয়াব স্টিক) মাধ্যমে। এই নমুনা বিশেষ তাপমাত্রায় পাত্রে রেখে তা ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হয়। কাজটি করেন মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা। নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রশিক্ষণ দরকার হয়। কিন্তু মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্তসংখ্যক টেকনোলজিস্ট নেই। বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ১০ বছর ধরে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ রেখেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর। উপজেলা পর্যায়ে বা গ্রামে কারা নমুনা সংগ্রহ করছেন, তার সঠিক উত্তর স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা নিজেরাই নমুনা সংগ্রহ করছেন বলে জানা গেছে।
ল্যাবরেটরি থেকে অভিযোগ এসেছে, লালা সংগ্রহের সময় সব ক্ষেত্রে সোয়াব স্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে না। লালা রাখার পর পাত্রের মুখ ঠিকমতো আটকানো হচ্ছে না। এমন নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। বাদ দিতে হচ্ছে।
অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সংগৃহীত কিছু নমুনা বাদ পড়ে যাচ্ছে। এটা তারা ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
সার্বিক বিষয়ে ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, নমুনা সংগ্রহ করা জানতে হবে, সঠিকভাবে সংগ্রহ করতে হবে। এসব কাজে আরো সজাগ হতে হবে। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ল্যাবরেটরি হতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী। তা না হলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে, পরীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।’