3
মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের মানুষের কাছে বহু বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী হাট হিসেবে বেশ পরিচিত মুন্সীরহাট বাজার। এই বাজাটিকে ঘিরে জেলা সদরের ৯ টি ইউনিয়নের লাখ লাখ মানুষের মিলন মেলা ঘটতো সাপ্তাহে দু”দিন। সাপ্তাহে শনি আর মঙ্গলবার বসে সাপ্তাহিক হাট। চরাঞ্চলের চরকেওয়ার, আধারা, মোল্লাকান্দি, বাংলাবাজার, শিলই, মহাকালী, বজ্রযোগিনী, পঞ্চসার ইউনিয়নসহ পার্শবর্তী টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মানুষও এই হাটে আসতো। তৎকালীন সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যম ছিলো নৌকা বা ট্রলার। জনশ্রæতি মতে, মুন্সীগঞ্জ এর সাথে মিল রেখে মুন্সীরহাট বাজারটির নাম করন করা হয়েছে। তবে প্রবীন ব্যক্তিদের সাথে কথোকপতানকালে জানাগেছে, বহু আগে এই বাজারে প্রথমে একজন মুন্সী দোকান চালাতো। সেই থেকেই মুন্সীর দোকান এরপর মুন্সীরহাট হিসেবে এই বাজারটি পরিচিতি লাভ করে বলে জানান একাধিক প্রবীন ব্যক্তি।
সোনালি আঁশ হিসেবে পরিচিত উৎপাদিত পাট, ধান, তিল, মরিচ, কাউনসহকৃষিপণ্য এই হাটেই আড়তে বিক্রি হতো। ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নির্ভরযোগ্য হাট ছিলো এটি। এ হাটে বিভিন্ন পণ্যের স্থায়ী বিক্রেতার সংখ্যা ছিলো চার শতাধিক। পৌরসভায় রূপান্তরের আগে সব কাঁচা রাস্তা ছিল। ক্রেতা-বিক্রেতাদের পণ্য পরিবহন ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌকা বা ট্রলার। ক্রেতারাও নিত্যপ্রজোনীয় পণ্য কিনে নৌকা বা ট্রলারে নিয়ে ছুটে যেতেন নিজ নিজ গন্তব্যে। জেলা সদরের প্রতিটা এলাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় নদীতে এখন আর আগের মত ট্রলার চলছেনা। প্রায় ১৫ বছর পূর্বেও মুন্সীরহাট বাজারঘাটে ছিলো শত শত মালবাহী এবং যাত্রীবাহী ট্রলারের ব্যাপক উপস্থিতি। ঘাটে শত শত শ্রমিক কুলি মজুরের কাজ করতো। দিন ভর ক্রেতাÑ বিক্রেতাদের উপস্থিতিতে বাজারটি থাকতো কোলাহল পূর্ন। কৃষকরা তাদের উৎ’পাদিত পন্য বাজারে এনে বিক্রি করে বাজার করে বাড়ী ফিরতো। একটা সময় সকল মানুষের দৈন্দদিন চাহিদার একমাত্র কেন্দ্র বিন্দু ছিলো মুন্সীরহাট বাজার। কিন্তু কালের বিবর্তনে হাটটি আজ তার ঐতিহ্য হারাতে যাচ্ছে।
বাজার সুত্রে জানাগেছে, চারিদিকে খাল ও নদী ভরাট। সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারনে আস্তে আস্তে বাজারটি তার ঐতিহ্য হারাতে থাকে। একটা সময়ে এই বাজারটিতে বিভিন্ন এলাকায় থেকে হাজার হাজার মানুষ আসতো নৌপথে। কিন্তু এখনও চরাঞ্চলের কিছু এলাকার লোক ট্রলারযোগে বাজারে আসেন। পাট ধান, চাল, তিলসহ কৃষি পন্যের আড়ৎগুলো আর এখন নেই। পূরানো কিছু পাইকারী দোকান এখনও আছে। তবে জেলার অন্যান্য হাটবাজারগুলোও মতোই চলছে হাটটি। বাজারটির ঐতিহ্য কিছুটা ধরে রেখেছে গরুর হাটটি। দেশি গরুসহ গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও কবুতরের জন্য হাটটি এখনও বিখ্যাত। জেলা সদরের অন্যতম বৃহৎ গরুর হাট এটি। জনজীবনে ব্যবহৃত সব পণ্যের সমাহার থাকলেও এখানে সাপ্তাহিক হাটের দিন গরু কেনার জন্যই দূর দূরান্ত থেকে মানুষ বেশী আসে। শাড়ি, লুঙ্গি, মাছ, কাঁসা-পিতল, মাটির তৈরি গৃহস্থালির আসবাবসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য পাওয়া যায় এ হাটে। বিভিন্ন কারণে এ হাটের কদর কমলেও এখনও ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ী আসেন এ হাটে। শুরু থেকেই শনি ও মঙ্গলবার বসে এ হাট। গবাদিপশু এ হাটের মূল আকর্ষণ। এছাড়ও নানা সমস্যায় জর্জরিত এই হাটে নেই কোন গণসৌচাগার, যেটা আছে সেটাও ব্যবহার উপযোগী নয়। প্রায় ৪৫০টিও অধিক দোকান আছে বাজারটিতে। বাজারের খাম্বাগুলোতেও কোন বাতি নেই। রাতের সময়টা অন্ধকারে ডেকে যায় বাজারটি ।
একাধিক প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপে জানা যায়, এক সময় সদর উপজেলার গ্রামাঞ্চলের পাঁচ ইউনিয়নের মানুষ এ হাটের ওপর নির্ভরশীল ছিল। দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতা আসতেন এখানে। খুব সকাল থেকেই বিক্রেতারা হাটে আসতে শুরু করেন। ক্রেতারাও খুব সকালে আসেন কেনাকাটা করতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। মাংস, মাছ, সবজির বেচাকেনা দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। গরু, ছাগল, হাঁস, কবুতর, শাড়ি, লুঙ্গিসহ অন্যান্য পণ্যের বেচাকেনা চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বাঁশ বা বাঁশের তৈরি বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হতো, যা এখনও পাওয়া যায় এ হাটে।
কৃষক সামাদ আলী বলেন, এলাকায় বিয়েসহ বিভিন্ন ধরনের ভোজ অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ ঠিক করা হতো হাটবারের সঙ্গে মিল রেখে। শনি বা মঙ্গলবারের পরদিন নির্ধারিত হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ, যেন হাট থেকে পণ্য কিনে অতিথি আপ্যায়ন করা যায়। তিনি আরো বলেন, কৃষকরা পন্য নিয়ে এই হাটেই এসে বিক্রি করিত। এখন হাটে আগের মত জনগমাগম নেই।
মুন্সীরহাট বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারন সম্পাদক মো: রবিউল আউয়াল (রবি মেম্বার) জানান,আগে ট্রলারযোগে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসতো। নদী আর খালগুলো পলিজমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নৌপথে যোগাযোগ কমে গেছে। মানুষ এখন সড়ক পথে চলাচল করে। এছাড়ও নিত্য পন্য এখন বিভিন্ন এলাকায় সহজেই পাওয়া যায়। কৃষিপন্য স্থানীয় ব্যবসায়রাই এখন কিনে নিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সাপ্তাহিক হাট ঠিক আগের মতোই জমজমাট থাকে। বিশেষ করে গরুরহাটটি আজও আগের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।